কথাটা শুনে তপনের চোখ মার্বেল হয়ে গেলো!
নতুন মেসোমশাই, মানে যাঁর সঙ্গে এই কদিন আগে তপনের ছোটোমাসির বিয়ে হয়ে গেল দেদার ঘটাপটা করো, সেই তিনি নাকি বই লেখেন। সে সব বই নাকি ছাপাও হয়। অনের বই ছাপা হয়েছে মেসোর।
তার মানে -তপনের নতুন মেসোমশাই একজন লেখক। সত্যিকার লেখক।
জলজ্যান্ত একজন লেখককে এত কাছ থেকে কখনো দেখেনি তপন, দেখা যায়, তাই জানতো না । লেখকরা যে তপনের বাবা, ছোটোমামা বা মেজোকাকুর মতো মানুষ, এবিষয়ে সন্দেহ ছিল তপনের।
কিছু নতুন মেসোকে দেখে জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল তপনের।
আশ্চর্য, কোথাও কিছু উলটোপালটা নেই, অন্য রকম নেই, একেবারে নিছক মানুষ! সেই ওঁদের মতোই দাড়ি কামান, সিগারেট খান, খেতে বসেই ‘আরে ব্যস, এত কখনো খওয়া যায়?” বলে অর্ধেক তুলিয়ে দেন, চানের সময় চান করেন এবং ঘুমের সময় ঘুমোন।
তাছাড়া-
ঠিক ছোটো মামাদের মতোই খবরের কাগজের সব কথা নিয়ে প্রবলভাবে গল্প করেন, তর্ক করেন, আর শেষ পর্যন্ত ‘এ দেশের কিছু হবে না’ বলে সিনেমা দেখতে চলে যান, কী বেড়াতে বেরোন সেজেগুজে।
মামার বাড়িতে এই বিয়ে উপলক্ষ্যেই এসেছে তপন, আর ছুটি আছে বলেই রয়ে গেছে। ওদিকে মেসোরও না কী গরমের ছুটি চলছে। তাই মেসো শ্বশুরবাড়িতে এসে রয়েছেন কদিন।
তাই অহরহই জলজ্যান্ত একজন লেখককে দেখবার সুযোগ হবেই তপনের। আর সেই সুযোগেই দেখতে পাচ্ছে তখন, ‘লেখক’ মানে কোনো আকাশ থেকে পড়া জীব নয়, তপনদের মতোই মানুষ।
তবে তপনেরই বা লেখক হতে বাধা কী?
মেসোমশাই কলেজের প্রফেসার, এখন ছুটি চলছে তাই সেই সুযোগে শ্বশুরবাড়িতেই রয়ে গেছেন কদিন। আর সেই সুযোগেই দিব্যি একখনি দিবানিদ্রা দিচ্ছিলেন। ছোটোমাসি সেই দিকে ধাবিত হয়।
তপন অবশ্য ‘না আ-আ-‘ করে প্রবল আপত্তি তোলে, কিন্তু কে শোনে তার কথা ?
ততক্ষণে তো গল্প ছোটোমেসোর হাতে চলেই গেছে। হইচই করে দিয়ে দিয়েছে ছোটোমাসি তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে?
তপন অবশ্য মাসির এই হইচইতে মনে মনে পুলকিত হয়। মুখে আঁ আঁ করলেও হয়।
কারণ লেখার প্রকৃত মুল্য বুঝলে নতুন মেসোই বুঝবে। রত্নের মূল্য জহুরির কাছেই।
একটু পরেই ছোটোমেসো ডেকে পাঠান তপনকে এবং বোধকরি নতুন বিয়ের শশুরবাড়ির ছেলেকে খুশি করতেই বলে ওঠেন, ‘তপন, তোমার গল্প তো দিব্যি হয়েছে। একটু ‘কারেকশান’ করে ইয়ে করে দিলে ছাপতে দেওয়া চলে।’
তখন প্রথমটা ভাবে ঠাট্টা, কিন্তু যখন দেখে মেসোর মুখে করুণার ছাপ, তখন আহ্লাদে কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়।
“তা হলে বাপু তুমি ওর গল্পটা ছাপিয়ে দিও-মাসি বলে, “‘মেসোর উপযুক্ত কাজ হবে সেটা।’
মেসো তেমনি করুণার মূর্তিতে বলেন, ‘তা দেওয়া যায়। আমি বললে ‘সন্ধ্যাতারা’র সম্পাদক ‘না’ করতে পারবে না। ঠিক আছে, তপন, তোমার গল্প আমি ছাপিয়ে দেবো।
বিকেলে চায়ের টেবিলে ওঠে কথাটা।
আর সবাই তপনের গল্প শুনে হাসে। কিন্তু মেসো বলেন, ‘না না আমি বলছি— তপনের হাত আছে। চোখও আছে। নচেৎ এই বয়সের ছেলেমেয়েরা গল্প লিখতে গেলেই তো – হয় রাজারানির গল্প লেখে, নয় তো—খুন জখম আকসিডেন্ট, অথবা না খেতে পেয়ে মরে যাওয়া, এইসব মালমশলা নিয়ে বসে। তপন যে সেই দিকে যায়নি, শুধু ওর ভরতি হওয়ার দিনের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির বিষয় নিয়ে লিখেছে, এটা খুব ভালো। ওর হবে। ‘
তখন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায়।
তারপর ছুটি ফুরোলে মেসো গল্পটি নিয়ে চলে গেলেন। তপন কৃতার্থ হয়ে বসে বসে দিন গোনে।
এই কথাটাই ভাবছে তপন রাত-দিন। ছেলেবেলা থেকেই তো রাশি রাশি গল্প শুনেছে তপন আর এখন বস্তা বস্তা পড়ছে, কাজেই গল্প জিনিসটা যে কী সেটা জানতে তো বাকি নেই?
শুধু এইটাই জানা ছিল না, সেটা এমনই সহজ মানুষেই লিখতে পারে। নতুন মেসোকে দেখে জানল সেটা।
তবে আর পায় কে তপনকে?
দুপুরবেলা, সবাই যখন নিথর নিথর, তখন তপন আস্তে একটি খাতা (হোম টাস্কের খাতা আর কী! বিয়ে বাড়িতেও যেটি মা না আনিয়ে ছাড়েননি।) আর কলমটি নিয়ে তিনতলার সিঁড়িতে উঠে গেল, আর তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, একাসনে বসে লিখেও ফেলল আস্ত একটা গল্প।
লেখার পর যখন পড়ল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তপনের, মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল।
এ কী ব্যাপার!
এ যে সত্যিই হুবহু গল্পের মতোই লাগছে! তার মানে সত্যিই একটা গল্প লিখে ফেলেছে তপন। তার মানে তপনকে এখন ‘লেখক’ বলা চলে।
হঠাৎ ভয়ানক একটা উত্তেজনা অনুভব করে তপন, আর দুদ্দাড়িয়ে নীচে নেমে এসে -ছোটোমাসিকেই বলে বসে, ‘ছোটোমাসি, একটা গল্প লিখেছি।’
ছোটোমাসিই ওর চিরকালের বন্ধু, বয়সে বছর আষ্টেকের বড়ো হলেও সমবয়সি, কাজেই মামার বাড়ি এলে সব কিছুই ছোটোমাসির কাছে। তাই এই ভয়ানক আনন্দের খবরটা ছোটোমাসিকে সর্বাগ্রে দিয়ে বসে।
তবে বিয়ে হয়ে ছোটোমাসি যেন একটু মুরুব্বি মুরুব্বি হয়ে গেছে, তাই গল্প সবটা না পড়েই একটু চোখ বুলিয়েই বেশ পিঠ চাপড়ানো সুরে বলে, ‘ওমা এ তো বেশ লিখেছিস রে। কোনোখান থেকে টুকলিফাই করিসনি তো?’
‘আঃ ছোটোমাসি, ভালো হবে না বলছি।’
“আরে বাবা খেপছিস কেন? জিজ্ঞেস করছি বই তো নয়! রোস তোর মেসোমশাইকে দেখাই।’ কিন্তু গেলেন তো – গেলেনই যে।
কোথায় গল্পের সেই আটঁসাঁট ছাপার অক্ষরে গাঁথা চেহারাটি? যার জন্যে হাঁ করে আছে তপন। মামার বাড়ি থেকে বাড়িতে চলে এসেও।
এদিকে বাড়িতে তপনের নাম হয়ে গেছে, কবি, সাহিত্যিক, কথাশিল্পী। আর উঠতে বসতে ঠাট্টা করছে ‘তোর হবে। হ্যাঁ বাবা তোর হবে।’
তবু এইসব ঠাট্টা-তামাশার মধ্যেই তপন আরো দু’তিনটে গল্প লিখে ফেলেছে। ছুটি ফুরিয়ে এসেছে, হোম টাস্ক হয়ে ওঠেনি, তবু লিখছে। লুকিয়ে লিখছে। যেন নেশায় পেয়েছে।
তারপর ছুটি ফুরোল, রীতিমতো পড়া শুরু হয়েছে। প্রথম গল্পটি সম্পর্কে একেবারে আশা ছাড়া হয়ে গেছে, বিষন্ন মন নিয়ে বসে আছে এমন সময় ঘটল সেই ঘটনা।
ছোটোমাসি আর মেসো একদিন বেড়াতে এল, হাতে এক সংখ্যা ‘সন্ধ্যাতারা”।
কেন? হেতু? ‘সন্ধ্যাতারা’ নিয়ে কেন?
বুকের রক্ত ছলকে ওঠে তপনের।
তবে কী? সত্যিই তাই? সত্যিই তপনের জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনটি এল আজ?
কিন্তু তাই কী সম্ভব? সত্যিকার ছাপার অক্ষরে তপন কুমার রায়ের লেখা গল্প, হাজার হাজার ছেলের হাতে হাতে ঘুরবে?
পৃথিবীতে এমন অলৌকিক ঘটনাও ঘটে। তা ঘটেছে, সত্যিই ঘটেছে।
সুচিপত্রেও নাম রয়েছে।
‘প্রথম দিন’ (গল্প) শ্রী তপন কুমার রায়।
সারা বাড়িতে শোরগোল পড়ে যায়, তপনের লেখা গল্প পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ওর লেখক মেসো ছাপিয়ে দিয়েছে। পত্রিকাটি সকলের হাতে হাতে ঘোরে, সকলেই একবার করে চোখ বোলায় আর বলে, ‘বারে, চমৎকার লিখেছে তো।’
মেসো অবশ্য মৃদু মৃদু হাসেন, বলেন, ‘একটি -আধটু কারেকশান করতে হয়েছে অবশ্য। নেহাত কাঁচা তো?
মাসি বলে, ‘তা হোক, নতুন নতুন অমন হয় -‘
ক্রমশ ও কথাটাও ছড়িয়ে পড়ে।
ওই কারেকশানের কথা।
বাবা বলেন, ‘তাই। তা নইলে ফট করে একটা লিখল, আর ছাপা
হলো,- ‘
মেজোকাকু বলেন, ‘তা ওরকম একটি লেখক মেসো থাকা মন্দ নয়। আমাদের থাকলে আমরাও চেষ্টা করে দেখতাম।’
ছোটোমাসি আত্মপ্রসাদের প্রসন্নতা নিয়ে বসে বসে ডিম ভাজা আর চা খায়, মেসো শুধু কফি।
আজ আর অন্য কথা নেই, শুধু তপনের গল্পের কথা, আর তপনের নতুন মেসোর মহাত্বের কথা। উনি নিজে গিয়ে না দিলে কি আর ‘সন্ধ্যাতারা’-র সম্পাদক তপনের গল্প কড়ে আঙুল দিয়ে ছুঁতো?
তপন যেন কোথায় হারিয়ে যায় এইসব কথার মধ্যে। গল্প ছাপা হলে যে ভয়ংকর আহ্লাদটা হবার কথা, সে আহ্লাদ খুঁজে পায় না।
অনেকক্ষণ পরে মা বলেন, ‘কই তুই নিজের মুখে একবার পড় তো তপন শুনি! বাবা, তোর পেটে পেটে এত!”
এতক্ষণে বইটা নিজের হাতে পায় তপন।
মা বলেন, ‘কই পড়? লজ্জা কী? পড়, সবাই শুনি।’
তপন লজ্জা ভেঙে পড়তে যায়।
কেশে গলা পরিষ্কার করে।
কিন্তু এ কী!
এসব কী পড়ছে তপন?
এ কার লেখা?
এর প্রত্যেকটি লাইন তো নতুন আনকোরা, তপনের অপরিচিত।
এর মধ্যে তখন কোথা?
তার মানে মেসো তপনের গল্পটিকে আগাগোড়াই কারেকশান করেছেন। অর্থাৎ নতুন করে লিখেছেন, নিজের পাকা হাতে কলমে! তপন আর পড়তে পারে না। বোবার মতো বসে থাকে। তারপর ধমক খায়, কীরে তোর যে দেখি পায়া ভারী হয়ে গেল। সবাই শুনতে চাইছে তবু পড়ছিস না ? না কি অতি আহ্লাদে বাক্য হরে গেল।
তপন গড়গড়িয়ে পড়ে যায়। তপনের মাথায় ঢোকে না- সে কী পড়ছে। তবু ‘ধন্যি ধন্যি? পড়ে যায়। আর একবার রব ওঠে তপনের লেখক মেসো তপনের গল্পটি ছাপিয়ে দিয়েছে।
তপন বইটা ফেলে রেখে চলে যায়, তপন ছাতে উঠে গিয়ে শার্টের তলাটা তুলে চোখ মোছে। তপনের মনে হয় আজ যেন তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন। কেন? তা জানে না তপন।
শুধু এই দুঃখের মুহূর্তে গভীরভাবে সংকল্প করে তপন, যদি কখনো লেখা ছাপতে হয় তো, তপন নিজে গিয়ে দেবে। নিজের কাঁচা লেখা। ছাপা হয় হোক, না হয় না হোক।
তপনকে যেন আর কখনো শুনতে না হয় ‘অমুক তপনের লেখা ছাপিয়ে দিয়েছে।’
আর তপনকে যেন নিজের গল্প পড়তে বসে অন্যের লেখা লাইন পড়তে না হয়।
তার চেয়ে দুঃখের কিছু নেই, তার থেকে অপমানের!
নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দেখ👇