Latest Notes

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার প্রশ্ন উত্তর | একাদশ শ্রেণি সেমিস্টার ১ বিশাল ডানাওয়ালা থুরথুরে এক বুড়ো – গাবিরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ সাম্যবাদী (কবিতা) – কাজী নজরুল ইসলাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (কবিতা)- মাইকেল মধুসূদন দত্ত তেলেনাপোতা আবিষ্কার(গল্প) – প্রেমেন্দ্র মিত্র ছুটি (Chhuti) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিড়াল – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুঁই মাচা MCQ একাদশ শ্রেণী | 1st Semester পুঁই মাচা-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় MCQ from The Bangle Sellers – Sarojini Naidu

পথের দাবী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

পুলিশ – স্টেশনে প্রবেশ করিয়া দেখা গেল, সুমুখের হলঘরে জন – ছয়েক বাঙালি মােট – ঘাট লইয়া বসিয়া আছে, জগদীশবাবু ইতিমধ্যেই তাহাদের টিনের তোরঙ্গ ও ছোটো – বড়াে পুঁটলি খুলিয়া তদারক শুরু করিয়া দিয়াছেন। শুধু যে লােকটির প্রতি তাঁহার অত্যন্ত সন্দেহ হইয়াছে তাহাকে আর একটা ঘরে আটকাইয়া রাখা হইয়াছে। ইহারা সকলেই উত্তর – ব্রহ্মে বর্মা – অয়েল – কোম্পানির তেলের খনির কারখানায় মিস্ত্রির কাজ করিতেছিল, সেখানের জলহাওয়া সহ্য না হওয়ায় চাকরির উদ্দেশে রেঙ্গুনে চলিয়া আসিয়াছে। ইহাদের নাম ধাম ও বিবরণ লইয়া ও সঙ্গের জিনিসপত্রের পরীক্ষা করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইলে, পােলিটিক্যাল সাসপেক্ট সব্যসাচী মল্লিককে নিমাইবাবুর সম্মুখে হাজির করা হইল। লােকটি কাশিতে কাশিতে আসিল। অত্যন্ত ফরসা রং রৌদ্রে পুড়িয়া যেন তামাটে হইয়াছে। বয়স ত্রিশ – বত্রিশের অধিক নয়, কিন্তু ভারী রােগা দেখাইল। এইটুকু কাশির পরিশ্রমেই সে হাঁপাইতে লাগিল। সহসা আশঙ্কা হয়, সংসারের মিয়াদ বােধ করি বেশি দিন নাই ; ভিতরের কী একটা দুরারােগ্য রােগে সমস্ত দেহটা যেন দ্রুতবেগে ক্ষয়ের দিকে ছুটিয়াছে। কেবল আশ্চর্য সেই রােগা মুখের অদ্ভুত দুটি চোখের দৃষ্টি। সে চোখ ছােটো কি বড়াে, টানা কি গােল, দীপ্ত কি প্রভাহীন এ – সকল বিবরণ দিতে যাওয়াই বৃথা — অত্যন্ত গভীর জলাশয়ের মতাে কী যে তাহাতে আছে, ভয় হয় এখানে খেলা চলিবে না, সাবধানে দুরে দাঁড়ানােই প্রয়ােজন। ইহারই কোন অতল তলে তাহার ক্ষীণ প্রাণশক্তিটুকু লুকানাে আছে, মৃত্যুও সেখানে প্রবেশ করিতে সাহস করে না। কেবল এই জন্যই যেন সে আজও বাঁচিয়া আছে। অপূর্ব মুগ্ধ হইয়া সেইদিকে চাহিয়া ছিল, সহসা নিমাইবাবু তাহার বেশভূষার বাহার ও পারিপাট্যের প্রতি অপূর্বর দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়া সহাস্যে কহিলেন, বাবুটির স্বাস্থ্য গেছে, কিন্তু শখ যােলাে আনাই বজায় আছে তা স্বীকার করতে হবে। কী বল অপূর্ব ?

এতক্ষণে অপূর্ব তাহার পরিচ্ছদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া মুখ ফিরাইয়া হাসি গােপন করিল। তাহার মাথার সম্মুখদিকে বড়াে বড়াে চুল , কিন্তু ঘাড় ও কানের দিকে নাই বলিলেই চলে, —এমনি ছােটো করিয়া ছাঁটা। মাথায় চেরা সিঁথি, অপর্যাপ্ত তৈলনিষিক্ত, কঠিন, রুগ্ন, কেশ হইতে নিদারুণ নেবুর তেলের গন্ধে ঘর ভরিয়া উঠিয়াছে। গায়ে জাপানি সিল্কের রামধনু রঙের চুড়িদার পাঞ্জাবি, তাহার বুক – পকেট হইতে বাঘ – আঁকা একটা রুমালের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে, উত্তরীয়ের কোনাে বালাই নাই। পরনে বিলাতি মিলের কালাে মখমল পাড়ের সুক্ষ্ম শাড়ি, পায়ে সবুজ রঙের ফুল মােজা – হাঁটুর উপরে লাল ফিতা দিয়া বাঁধা, বানিশ – করা পাম্প শু, তলাটা মজবুত ও টিকসই করিতে আগাগােড়া লােহার নাল বাঁধানাে, হাতে একগাছি হরিণের শিঙের হাতল দেওয়া বেতের ছড়ি, কয়দিনের জাহাজের ধকলে সমস্তই নোংরা হইয়া উঠিয়াছে, ইহার আপাদমস্তক অপূর্ব বারবার নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, কাকাবাবু, এ লােকটিকে আপনি কোনাে কথা জিজ্ঞেস না করেই ছেড়ে দিন, যাকে খুঁজছেন সে যে এ নয়, তার আমি জামিন হতে পারি।

নিমাইবাবু চুপ করিয়া রহিলেন। অপূর্ব কহিল, আর যাই হােক, যাকে খুঁজছেন তার কালচরের কথাটা একবার ভেবে দেখুন।

নিমাইবাবু হাসিয়া ঘাড় নাড়িলেন, কহিলেন, তােমার নাম কী হে ?

আজ্ঞে , গিরীশ মহাপাত্র।

একদম মহাপাত্র! তুমিও তেলের খনিতেই কাজ করছিলে, না ? এখন রেঙ্গুনেই থাকবে ? তােমার বাক্স বিছানা তাে খানাতল্লাশি হয়ে গেছে, দেখি তােমার ট্যাঁকে এবং পকেটে কী আছে ?

তাহার ট্যাঁক হইতে একটি টাকা ও গণ্ডা – ছয়েক পয়সা বাহির হইল, পকেট হইতে একটা গোহার কম্পাস, মাপ করিবার কাঠের একটা ফুটরুল, কয়েকটা বিড়ি, একটা দেশলাই ও একটা গাঁজার কলিকা বাহির হইয়া পড়িল।

নিমাইবাবু কহিলেন, তুমি গাঁজা খাও ?

লােকটি অসঙ্কোচে জবাব দিল, আজ্ঞে না।

তবে এ বস্তুটি পকেটে কেন ?

আজ্ঞে, পথে কুড়িয়ে পেলাম, যদি কারও কাজে লাগে তাই তুলে রেখেচি ।

জগদীশবাবু এই সময়ে ঘরে ঢুকিতে নিমাইবাবু হাসিয়া কহিলেন, দেখাে জগদীশ, কীরূপ সদাশয় ব্যক্তি ইনি। যদি কারও কাজে লাগে তাই গাঁজার কলকেটি কুড়িয়ে পকেটে রেখেছেন। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিলেন, গাঁজা খাবার সমস্ত লক্ষণই তােমাতে বিদ্যমান বাবা, বললেই পারতে, খাই। কিন্তু কদিনই বা বাঁচবে, এই তাে তােমার দেহ, আর খেয়াে না। বুড়োমানুষের কথাটা শুনাে।

মহাপাত্র মাথা নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া বলিল, আজ্ঞে না মাইরি খাইনে। তবে ইয়ার বন্ধু কেউ তৈরি করে দিতে বললে দিই, এই মাত্র ! নইলে নিজে খাইনে।

জগদীশবাবু চটিয়া উঠিয়া কহিলেন, দয়ার সাগর! পরাকে সেজে দি , নিজে খাইনে। মিথ্যেবাদী কোথাকার !

অপূর্ব কহিল, বেলা হয়ে গেল, আমি এখন তবে চললুম কাকাবাবু।

নিমাইবাবু উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পারাে মহাপাত্র ! কী বল জগদীশ, পারে তাে ? জগদীশ সম্মতি জানাইলে কহিলেন, কিন্তু নিশ্চয় কিছুই বলা যায় না ভায়া, আমার মনে হয় এ শহরে আরও কিছুদিন নজর রাখা দরকার। রাত্রের মেল ট্রেনটার প্রতি একটু দৃষ্টি রেখাে, সে যে বর্মায় এসেছে এ খবর সত্য।

জগদীশ কহিলেন, তা হতে পারে, কিন্তু এই জানােয়ারটাকে ওয়াচ করবার দরকার নেই বড়ােবাবু। নেবুর তেলের গন্ধে ব্যাটা থানাসুদ্ধ লােকের মাথা ধরিয়ে দিলে ! বড়ােবাবু হাসিতে লাগিলেন। অপূর্ব পুলিশ – স্টেশন হইতে বাহির হইয়া আসিল, এবং প্রায় তাহার সঙ্গে সঙ্গেই মহাপাত্র তাহার ভাঙা টিনের তোরঙ্গ ও চাটাই – জড়ানাে ময়লা বিছানার বান্ডিল বগলে চাপিয়া ধীর মন্থরপদে উত্তর দিকের রাস্তা ধরিয়া সােজা প্রস্থান করিল।

আশ্চর্য এই যে, এত বড়াে সব্যসাচী ধরা পড়িল না, কোনাে দুর্ঘটনা ঘটিল না এমন সৌভাগ্যকেও অপূর্বর মন যেন গ্রাহ্যই করিল না। বাসায় ফিরিয়া দাড়ি – গোঁফ কামানাে হইতে শুরু করিয়া সন্ধ্যাহ্নিক, স্নানাহার, পােশাক – পরা, আফিস যাওয়া প্রভৃতি নিত্য কাজগুলায় বাধা পাইল না সত্য, কিন্তু ঠিক কী যে সে ভাবিতে লাগিল তাহার নির্দেশ নাই, অথচ চোখ – কান ও বুদ্ধি তাহার সাংসারিক সকল ব্যাপার হইতেই একেবারে যেন বিচ্ছিন্ন হইয়া কোন এক অদৃষ্ট অপরিজ্ঞাত রাজবিদ্রোহীর চিন্তাতেই ধ্যানস্থ হইয়া রহিল। এই অত্যন্ত অন্যমনস্কতা তলওয়ারকর লক্ষ করিয়া চিন্তিতমুখে জিজ্ঞাসা করিল, আজ বাড়ি থেকে কোন চিঠি পেয়েছেন নাকি?

কৈ না।

বাড়ির খবর সব ভালাে তাে ?

অপূর্ব কিছু আশ্চর্য হইয়া কহিল, যতদুর জানি সবাই ভালােই তাে আছেন।

রামদাস আর কোনাে প্রশ্ন করিল না। টিফিনের সময় উভয়ে একত্র বসিয়া জলযােগ করিত। রামদসের স্ত্রী অপূর্বকে একদিন সনির্বন্ধ অনুরােধ করিয়াছিলেন, যতদিন তাঁহার মা কিংবা বাসার আর কোনাে আত্মীয়া নারী এদেশে আসিয়া বাসার উপযুক্ত ব্যবস্থাদি না করেন ততদিন এই ছােটো বাহিনের হাতের তৈরি যৎসামান্য মিষ্টান্ন প্রত্যহ তাঁহাকে গ্রহণ করিতেই হইবে। অপূর্ব রাজি হইয়াছিল। আফিসের একজন ব্রাম্মণ পিয়াদা এই – সকল বহিয়া আনিত । আজও সে নিরালা পাশের ঘরটায় ভােজ্যবস্তুগুলি যখন সাজাইয়া দিয়া গেল, তখন আহারে বসিয়া অপূর্ব নিজেই কথা পাড়িল। কাল তাহার ঘরে চুরি হইয়া গেছে; সমস্তই যাইতে পারিত, কেবল উপরের সেই ক্রিশ্চান মেয়েটির কৃপায় টাকাকড়ি ছাড়া আর সমস্ত বাঁচিয়াছে। সে চোর তাড়াইয়া দরজায় নিজের তালা বন্ধ করিয়াছে, আমি বাসায় পৌঁছিলে চাবি খুলিয়া দিয়া অনাহূত আমার ঘরে ঢুকিয়া ছড়ানাে জিনিসপত্র গুছাইয়া দিয়াছে, সমস্ত ফর্দ করিয়া কী আছে আর কি গেছে তার এমন নিখুঁত হিসাব করিয়া দিয়াছে যে বােধ হয় তােমার মত পাশ – করা অ্যাকাউন্টেন্টের পক্ষেও বিস্ময়কর। বাস্তবিক, এমন তৎপর, এতবড়াে কার্যকুশলা মেয়ে আর যে কেহ আছে মনে হয় না হে তলওয়ারকর ! তা ছাড়া এত বড়াে বন্ধু।

রামদাস কহিল, তার পর ?

অপূর্ব বলিল, তেওয়ারি ঘরে ছিল না, বর্মা নাচ দেখতে ফয়ায় গিয়েছিল, ইত্যবসরে এই ব্যাপার। তার বিশ্বাস এ কাজ ও ছাড়া আর কেউ করেনি। আমারও অনুমান কতকটা তাই। চুরি না করুক, সাহায্য করেচে।

তার পর?

তারপর সকালে গেলাম পুলিশে খবর দিতে। কিন্তু পুলিশের দল এমন কাণ্ডকরলে, এমন তামাশা দেখালে যে ও – কথা আর মনেই হলাে না। এখন ভাবচি, যা গেছে তা যাক, তাদের চোর ধরে দিয়ে আর কাজ নেই, তারা বরঞ্চ এমনিধারা বিদ্রোহী ধরে ধরেই বেড়াক। এই বলিয়া তাহার গিরীশ মহাপাত্র ও তাহার পােশাক – পরিচ্ছদের বাহার মনে পড়িয়া হঠাৎ হাসির ছটায় যেন দম আটকাইবার উপক্রম হইল। হাসি থামিলে সে বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অসাধারণ পারদর্শী বিলাতের ডাক্তার উপাধিধারী রাজশত্রু মহাপাত্রের স্বাস্থ্য, তাহার শিক্ষা ও রুচি, তাহার বল – বীর্য, তাহার রামধনু রঙের জামা, সবুজ রঙের মােজা ও লােহার নালঠোকা পাম্প শু, তাহার নেবুর তেলের গন্ধবিলাস, সর্বোপরি তাহার পরহিতায় গাঁজার কলিকাটির আবিষ্কারের ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করিতে করিতে তাহার উৎকট হাসির বেগ কোনােমতে আর একবার সংবরণ করিয়া শেষে কহিল, তলওয়ারকর, মহা হুঁশিয়ার পুলিশের দলকে আজকের মতাে নির্বোধ আহম্মক হতে বােধ করি কেউ কখনাে দেখেনি। অথচ, গভর্নমেন্টের কত টাকাই না এরা বুনাে হাঁসের পিছনে ছুটোছুটি করে অপব্যয় করলে!

রামপাস হাসিয়া কহিল, কিন্তু বুনাে হাঁস ধরাই যে এদের কাজ; আপনার চোর ধরে দেবার জন্যে এরা নেই। আচ্ছা, এরা কি আপনাদের বাংলা দেশের পুলিশ ?

অপূর্ব কহিল, হাঁ। তা ছাড়া আমার বড়াে লজ্জা এই যে এদের যিনি কর্তা তিনি আমার আত্মীয়, আমার পিতার বন্ধু। বাবাই একদিন এর চাকরি করে দিয়েছিলেন।

রামদাস কহিল, তাহলে আপনাকেই হয়তো আর একদিন তার প্রায়শ্চিত্ত করাতে হবে। কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলিয়া সে – ই একটু অপ্রতিভ হইয়া চুপ করিল, আত্মীয়ের সম্বন্ধে এরূপ একটা মন্তব্য প্রকাশ করা হয়তাে শােভন হয় নাই। অপূর্ব তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া অর্থ বুঝিল, কিন্তু এই ধারণা যে সত্য নয়, ইহাই সতেজে ব্যক্ত করিতে সে জোর করিয়া বলিল, আমি তাকে কাকা বলি, আমাদের তিনি আত্মীয়, শুভাকাঙক্ষী, কিন্তু তাই বলে আমার দেশের চেয়ে তাে তিনি আপনার নন। বরঞ্চ, যাঁকে তিনি দেশের টাকায়, দেশের লােক দিয়ে শিকারের মতাে তাড়া করে বেড়াচ্ছেন তিনি ঢের বেশি আমার আপনার।

রামদাস মুচকিয়া একটু হাসিয়া কহিল, বাবুজি, এ – সব কথা বলার দুঃখ আছে।

অপূর্ব কহিল, থাকে, তাই নেব। কিন্তু তাই বলে তলওয়ারকর, —শুধু কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর যে – কোনাে দেশে, যে – কোনাে যুগে যে – কেউ জন্মভূমিকে তার স্বাধীন করবার চেষ্টা করেছে, তাকে আপনার নয় বলবার সাধ্য আর যার থাক আমার নেই। বলিতে বলিতে কণ্ঠস্বর তাহার তীক্ষ্ণ এবং চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল; মনে মনে বুঝিল কী কথায় কী কথা আসিয়া পড়িতেছে, কিন্তু সামলাইতে পারিল না, বলিল, তােমার মতাে সাহস আমার নেই, আমি ভীরু, কিন্তু তাই বলে অবিচারে দণ্ডভােগ করার অপমান আমাকে কম বাজে না রামদাস। বিনা দোষে ফিরিঙ্গি ছোঁড়ারা আমাকে যখন লাথি মেরে প্ল্যাটফর্ম থেকে বার করে দিলে, এবং এই অন্যায়ের প্রতিবাদ যখন করতে গেলাম, তখন সাহেব স্টেশনমাস্টার কেবলমাত্র আমাকে দেশি লােক বলেই দেশের স্টেশন থেকে কুকুরের মতাে দুর করে দিলে, —তার লাঞ্ছনা এই কালো চামড়ার নীচে কম জ্বলে না তলওয়ারকর! এমন তাে নিত্য – নিয়তই ঘটছে, আমার মা, আমার ভাই – বােনকে যারা এই – সব সহস্র কোটি অত্যাচার থেকে উদ্ধার করতে চায় তাদের আপনার বলে ডাকবার যে দুঃখই থাক আমি আজ থেকে মাথায় তুলে নিলাম।

রামদাসের সুশ্রী গৌরবর্ণ মুখ ক্ষণকালের জন্য আরক্ত হইয়া উঠিল, বলিল, কৈ এ ঘটনা তাে আমাকে বলেন নি?

অপুর্ব কহিল, বলা কি সহজ রামদাস? হিন্দুস্থানের লােক সেখানে কম ছিল না, কিন্তু, আমার অপমান কারও গায়েই ঠেকল না এমনি তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। লাথির চোটে আমার যে হাড় – পাঁজরা ভেঙে যায়নি এই সুখবরে তারা সব খুশি হয়ে গেল। তােমাকে জানাব কি — মনে হলে দুঃখে লজ্জায় ঘৃণায় নিজেই যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যাই।

রামদাস চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু তাহার দুই চোখ ছলছল করিয়া আসিল। সুমুখের ঘড়িতে তিনটা বাজিতে সে উঠিয়া দাঁড়াইল। বােধ হয় কী একটা বলিতে গেল, কিন্তু কিছুই না বলিয়া হঠাৎ হাত বাড়াইয়া অপূর্বর ডান হাতটা টানিয়া লইয়া একটা চাপ দিয়া নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলিয়া গেল।

সেই দিন বিকালে আফিসের ছুটি হইবার পূর্বে বড়োসাহেব একখানা লম্বা টেলিগ্রাম হাতে অপূর্বর ঘরে ঢুকিয়া কহিলেন, আমাদের ভামাের অফিসে কোনাে শৃঙ্খলাই হচ্ছে না। ম্যান্ডালে, শােএবাে , মিকথিলা এবং এদিকে প্রােম সব – কটা আফিসেই গােলযােগ ঘটচে। আমার ইচ্ছা তুমি একবার সবগুলাে দেখে আস। আমার অবর্তমানে সমস্ত ভারই তাে তােমার, -একটা পরিচয় থাকা চাই, সুতরাং বেশি দেরি না করে কাল – পরশু যদি একবার —

অপূর্ব তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া বলিল, আমি কালই বার হয়ে যেতে পারি। বস্তুত, নানা কারণে রেঙ্গুনে তাহার আর একমুহূর্ত মন টিকিতে ছিল না। উপরন্তু , এই সূত্রে দেশটাও একবার দেখা হইবে। অতএব যাওয়াই স্থির হইল, এবং পরদিনই অপরাহ্ণবেলায় সুদূর ভামাে নগরের উদ্দেশে যাত্রা করিয়া সে ট্রেনে চাপিয়া বসিল। সঙ্গে রহিল আরদালি এবং আফিসের একজন হিন্দুস্থানি ব্রাহ্মণ পিয়াদা। তেওয়ারি খবরদারির জন্য বাসাতেই রহিল। পা – ভাঙা সাহেব হাসপাতালে পড়িয়া, সুতরাং তেমন আর ভয় নাই। বিশেষত, এই রেঙ্গুন শহরটি বরং সহিয়াছিল, কিন্তু আরও অজানা স্থানে পা বাড়াইবার তাহার প্রবৃণ্ডিই ছিল না। তলওয়ারকর তেওয়ারির পিঠ ঠুকিয়া দিয়া সাহস দিয়া কহিল, তোমার চিন্তা নেই ঠাকুর, কোনাে কিছু হলেই অফিসে গিয়ে আমাকে সংবাদ দিয়ো।

গাড়ি ছাড়িতে বােধ করি তখনও মিনিট – পাঁচেক বিলম্ব ছিল, অপূর্ব হঠাৎ চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, ঔই যে ।

তলওয়ারকর ঘাড় ফিরাইতেই বুঝিল, এই সেই গিরীশ মহাপাত্র। সেই বাহারে জামা, সেই সবুজ রঙের ফুল মােজা, সেই পাম্প শু এবং ছড়ি, প্রভেদের মধ্যে এখন কেবল সেই বাঘ আঁকা রুমালখানি বুকপকেট ছাড়িয়া তাহার কণ্ঠে জড়ানাে। মহাপাত্র এই দিকেই আসিতেছিল, সমুখে আসিতেই অপূর্ব ডাকিয়া কহিল, কি হে গিরীশ, আমাকে চিনতে পারো? কোথায় চলেচ?

গিরীশ শশব্যস্তে একটা মস্ত নমস্কার করিয়া কহিল, আজ্ঞে, চিনতে পারি বৈ কি বাবুমশায় । কোথায় । আগমন হচ্ছেন ?

অপূর্ব সহাস্যে কহিল, আপাতত ভামাে যাচ্চি। তুমি কোথায়?

গিরীশ কহিল, আজ্ঞে, এনাঞ্জাং থেকে দুজন বন্ধু নােক আসার কথা ছিল, আমাকে কিন্তু বাবু ঝুটমুট হয়রান করা। হাঁ, আনে বটে কেউ কেউ আপিং সিদ্ধি লুকিয়ে , কিন্তু, আমি বাবু ভারী ধর্মভীরু মানুষ। বলি কাজ কি বাপু জুচ্চুরিতে — কথায় বলে পরােধর্ম ভয়াবয়। লল্লাটের লেখা তাে খন্ডাবে না।

অপূর্ব হাসিয়া কহিল, আমারও তাে তাই বিশ্বাস। কিন্তু তােমার বাপু একটা ভুল হয়েছে, আমি পুলিশের লােক নই, আফিম সিদ্ধির কোনো ধার ধারিনে, -সেদিন কেবল তামাশা দেখতেই গিয়েছিলাম।

তলওয়ারকর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহাকে দেখিতেছিল, কহিল, বাবুজি, ম্যয় নে আপকো তাে জরুর কঁহা দেখা –

গিরীশ কহিল, আশ্চয্যি নেহি হ্যায় বাবু সাহেব, নােকরির বাস্তে কেত্তা যায়গায় তাে ঘুমতা হ্যায়,-

অপূর্বকে বলিল, কিন্তু আমার ওপর মিথ্যে সন্দেহ রাখবেন না বাবুমশায়, আপনাদের নজর পড়লে চাকরি একটা জুটবে না। বামুনের ছেলে, বাংলা লেখাপড়া, শাস্তর – টাস্তর সবই কিছু কিছু শিখেছিলাম, কিন্তু এমন আদেষ্ট যে – বাবুমশায় আপনারা –

অপূর্ব কহিল, আমি ব্রাহ্মণ।

আজ্ঞে, তা হলে নমস্কার। এখন তবে আসি, -বাবুসাহেব, রাম রাম — বলিতে বলিতে গিরীশ মহাপাত্র একটা উদগত কাশির বেগ সামলাইয়া লইয়া বাপদে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল।

অপূর্ব কহিল, এই সব্যসাচীটির পিছনেই কাকাবাবু সদলবলে এদেশ ওদেশ করে বেড়াচ্ছেন তলওয়ারকর। বলিয়া সে হাসিল। কিন্তু এই হাসিতে তলওয়ারকর যােগ দিল না। পরক্ষণে বাঁশি বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিলে সে হাত বাড়াইয়া বন্ধুর করমর্দন করিল, কিন্তু তখনও মুখ দিয়া তাহার কথাই বাহির হইল না। নানা কারণে অপূর্ব লক্ষ করিল না, কিন্তু করিলে দেখিতে পাইত এই মুহূর্তকালের মধ্যে রামদাসের প্রশস্ত উজ্জ্বল ললাটের উপরে যেন কোন এক অদৃশ্য মেঘের ছায়া আসিয়া পড়িয়াছে, এবং সেই সুদূর দুর্নিরীক্ষ্য লােকেই তাহার সমস্ত মনশ্চক্ষু একেবারে উধাও হইয়া গিয়াছে।

অপূর্ব প্রথম শ্রেণির যাত্রী, তাহার কামরায় আর কেহ লােক ছিল না। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইলে সে পিরানের মধ্যে হইতে পৈতা বাহির করিয়া বিনা জলেই সায়ংসন্ধ্যা সমাপন করিল, এবং যে – সকল ভােজ্যবস্তু শাস্ত্রমতে স্পর্শদুষ্ট হয় না জানিয়া সে সঙ্গে আনিয়াছিল, পিতলের পাত্র হইতে বাহির করিয়া আহার করিল, জল ও পান তাহার ব্রাক্ষ্মণ আরদালি পূর্বাহেই রাখিয়া গিয়াছিল, এবং শয্যাও সে প্রস্তুত করিয়া দিয়া গিয়াছিল, অতএব রাত্রির মতাে অপূর্ব ভােজনাদি শেষ করিয়া হাতমুখ ধুইয়া পরিতৃপ্ত সুস্থচিত্তে শয্যা আশ্রয় করিল। তাহার ভরসা ছিল প্রভাতকাল পর্যন্ত আর তাহার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিবে না। কিন্তু ইহা যে কতবড়াে ভ্রম তাহা কয়েকটা স্টেশন পরেই সে অনুভব করিল। সেই রাত্রির মধ্যে বার – তিনেক তাহার ঘুম ভাঙাইয়া পুলিশের লোক তাহার নাম ও ধাম ও ঠিকানা লিখিয়া লইয়াছে। একবার সে বিরক্ত হইয়া প্রতিবাদ করায় বর্মা সব – ইনস্পেক্টর সাহেব কটুকষ্ঠে জবাব দেয়, তুমি তাে ইউরােপিয়ান নও।

অপূর্ব কহে, না। কিন্তু আমি তাে ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জার, রাত্রে তাে আমার তুমি ঘুমের বিঘ্ন করিতে পারাে না।

সে হাসিয়া বলে, ও নিয়ম রেলওয়ে কর্মচারীর জন্য,-  আমি পুলিশ; ইচ্ছা করিলে আমি তােমাকে টানিয়া নীচে নামাইতে পারি।

পথের দাবী – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রশ্নোত্তরঃ

পথের দাবী MCQ

পথের দাবী SAQ

Spread the love

You cannot copy content of this page