Latest Notes

চারণকবি কবিতা MCQ – ভারভারা রাও – একাদশ শ্রেণী সেমিস্টার ১ বিড়াল (প্রবন্ধ) MCQ- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | Class 11 Semester 1 সাম্যবাদী নজরুল ইসলাম MCQ প্রশ্নোত্তর | একাদশ শ্রেণী বাংলা নুন – জয় গোস্বামী একাদশ শ্রেণী লালন শাহ্ ফকিরের গান একাদশ শ্রেণী সেমিস্টার ২ ভাব সম্মিলন – বিদ্যাপতি চারণকবি – ভারভারা রাও বাংলা সমার্থক শব্দের তালিকা বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রবন্ধ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার প্রশ্ন উত্তর | একাদশ শ্রেণি সেমিস্টার ১

মোম্বাসা থেকে রেলপথ গিয়েচে কিসুমু-ভিক্টোরিয়া নায়ানজা হ্রদের ধারে তারই একটা শাখা লাইন তখন তৈরি হচ্ছিল। জায়গাটা মোম্বাসা থেকে সাড়ে তিনশো মাইল পশ্চিমে। ইউগান্ডা রেলওয়ের নুডসবার্গ স্টেশন থেকে বাহাত্তর মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। এখানে শংকর কনস্ট্রাকশন ক্যাম্পের কেরানি ও সরকারি স্টোরকিপার হয়ে এসেচে। থাকে ছোটো একটা তাঁবুতে। তার আশে-পাশে অনেক তাঁবু। এখানে এখনও বাড়িঘর তৈরি হয়নি বলে তাঁবুতেই সবাই থাকে। তাঁবুগুলো একটা খোলা জায়গায় চক্রাকারে সাজানো – তাদের চারিধারে ঘিরে বহু দূরব্যাপী মুক্ত প্রান্তর, লম্বা লম্বা ঘাসে ভরা, মাঝে মাঝে গাছ। তাঁবুগুলোর ঠিক গায়েই খোলা জায়গার শেষ সীমায় একটা বড়ো বাওবাব গাছ। আফ্রিকার বিখ্যাত গাছ, শংকর কতবার ছবিতে দেখেচে, এবার সত্যিকার বাওবাব দেখে শংকরের যেন আশ মেটে না।

নতুন দেশ, শংকরের তরুণ তাজা মন – সে ইউগান্ডার এই নির্জন মাঠ ও বনে নিজের স্বপ্নের সার্থকতাকে যেন খুঁজে পেলে। কাজ শেষ হয়ে যেতেই সে তাঁবু থেকে রোজ বেরিয়ে পড়ত – যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকে বেড়াতে বার হত পুবে, পশ্চিমে, দক্ষিণে, উত্তরে। সব দিকেই লম্বা লম্বা ঘাস, কোথাও মানুষের মাথা সমান উঁচু, কোথাও তার চেয়েও উঁচু।

কনস্ট্রাকশন তাঁবুর ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সাহেব একদিন শংকরকে ডেকে বললেন শোনো রায়, ওরকম এখানে বেড়িও না। বিনা বন্দুকে এখানে এক পা-ও যেও না। প্রথম, এই ঘাসের জমিতে পথ হারাতে পারো। পথ হারিয়ে লোকে এসব জায়গায় মারাও গিয়েচে জলের অভাবে। দ্বিতীয়, ইউগান্ডা সিংহের দেশ। এখানে আমাদের সাড়াশব্দ আর হাতুড়ি ঠোকার আওয়াজে সিংহ হয়তো একটু দূরে চলে গিয়েচে – কিন্তু ওদের বিশ্বাস নেই। খুব সাবধান। এসব অঞ্চল মোটেই নিরাপদ নয়।

একদিন দুপুরের পরে কাজকর্ম বেশ পুরোদমে চলচে, হঠাৎ তাঁবু থেকে কিছু দূরে লম্বা ঘাসের জমির মধ্যে মনুষ্যকণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল। সবাই সেদিকে ছুটে গেল ব্যাপার কী দেখতে। শংকরও ছুটল – ঘাসের জমি পাতি-পাতি করে খোঁজা হল – কিছুই নেই সেখানে।

কীসের চিৎকার তবে?

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এলেন। কুলিদের নাম-ডাকা হল, দেখা গেল একজন কুলি অনুপস্থিত। অনুসন্ধানে জানা গেল সে একটু আগে ঘাসের বনের দিকে কী কাজে গিয়েছিল, তাকে ফিরে আসতে কেউ দেখেনি।

খোঁজাখুঁজি করতে করতে ঘাসের বনের বাইরে বালির ওপরে ক-টা সিংহের পায়ের দাগ পাওয়া গেল। সাহের বন্দুক নিয়ে লোকজন সঙ্গে পায়ের দাগ দেখে দেখে অনেক দূর গিয়ে একটা বড়ো পাথরের আড়ালে হতভাগ্য কুলির রক্তাক্ত দেহ বার করলেন।

তাকে তাঁবুতে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হল। কিন্তু সিংহের কোনো চিহ্ন মিলল। -না। লোকজনের চিৎকারে সে শিকার পালিয়েচে। সন্ধ্যার পূর্বেই কুলিটা মারা গেল।

তাঁবুর চারিপাশের লম্বা ঘাস অনেক দূর পর্যন্ত কেটে সাফ করে দেওয়া গেল পরদিনই। দিনকতক সিংহের কথা ছাড়া তাঁবুতে আর কোনো গল্প নেই। তারপর মাসখানেক পরে ঘটনাটা পুরোনো হয়ে গেল, সে কথা সকলের মনে চাপা পড়ে গেল। কাজকর্ম আবার বেশ চলল।

সেদিন দিনে খুব গরম। সন্ধ্যার একটু পরেই কিন্তু ঠান্ডা পড়ল। কুলিদের তাঁবুর সামনে অনেক কাঠকুটো জ্বালিয়ে আগুন করা হয়েছে। সেখানে তাঁবুর সবাই গোল হয়ে গল্পগুজব করচে।শংকরও সেখানে আছে, সে ওদের গল্প শুনচে এবং অগ্নিকুণ্ডের
আলোতে ‘কেনিয়া মর্নিং নিউজ’ পড়চে। খবরের কাগজখানা পাঁচদিনের পুরোনো। কিন্তু এ জনহীন প্রান্তরে তবু এখানাতে বাইরের দুনিয়ার যা কিছু একটা খবর পাওয়া যায়।

তিরুমল আপ্পা বলে একজন মাদ্রাজি কেরানির সঙ্গে শংকরের খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিরুমল তরুণ যুবক, বেশ ইংরিজি জানে, মনেও খুব উৎসাহ। সে বাড়ি থেকে পলিয়ে এসেচে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। শংকরের পাশে বসে সে আজ সন্ধ্যা থেকে ক্রমাগত দেশের কথা, তার বাপ-মায়ের কথা, তার ছোটো বোনের কথা বলচে ! ছোটো বোনকে সে বড়ো ভালোবাসে। বাড়ি ছেড়ে এসে তার কথাই তিরুমলের বড়ো মনে হয়। একবার সে দেশের দিকে যাবে সেপ্টেম্বর মাসের শেষে। মাস-দুই ছুটি মঞ্জুর করবে না সাহেব?

ক্রমে রাত বেশি হল। মাঝে-মাঝে আগুন নিভে যাচ্ছে, আবার কুলিরা তাতে কাঠকুটো ফেলে দিচ্চে। আরও অনেকে উঠে শুতে গেল। কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদ ধীরে ধীরে দূর দিগন্তে দেখা দিল – সমগ্র প্রান্তর জুড়ে আলো-আঁধারে লুকোচুরি আর বুনো গাছের দীর্ঘ দীর্ঘ ছায়া।

শংকরের ভারী অদ্ভুত মনে হচ্ছিল বহুদূর বিদেশের এই স্তব্ধ রাত্রির সৌন্দর্য। কুলিদের ঘরের একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে একদৃষ্টে সে সম্মুখের বিশাল জনহীন তৃণভূমির আলো আঁধার-মাখা রূপের দিকে চেয়ে চেয়ে কত কী ভাবছিল। ওই বাওবাব গাছটার ওদিকে অজানা দেশের সীমা কেপটাউন পর্যন্ত বিস্তৃত মধ্যে পড়বে কত পর্বত, অরণ্য, প্রাগৈতিহাসিক যুগের নগর জিম্বারি – বিশাল ও বিভীষিকাময় কালাহারি মরুভূমি, হীরকের দেশ, সোনার খনির দেশ।

একজন বড়ো স্বর্ণান্বেষী পর্যটক যেতে যেতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। যে পাথরটাতে লেগে হোঁচট খেলেন সেটা হাতে তুলে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন, তার সঙ্গে সোনা মেশানো রয়েছে। সে জায়গায় বড়ো একটা সোনার খনি বেরিয়ে পড়ল। এ ধরনের কত গল্প সে পড়েচে দেশে থাকতে।

এই সেই আফ্রিকা, সেই রহস্যময় মহাদেশ, সোনার দেশ, হিরের দেশ –- কত অজানা জাতি, অজানা দৃশ্যাবলি, অজানা জীবজন্তু এর সীমাহীন ট্রপিক্যাল অরণ্যে আত্মগোপন করে আছে, কে তার হিসেব রেখেচে?

কত কী ভাবতে-ভাবতে শংকর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ কীসের শব্দে তার ঘুম ভাঙল। সে ধড়মড় করে জেগে উঠে বসল। চাঁদ আকাশে অনেকটা উঠেছে। ধবধবে সাদা জ্যোৎস্না দিনের মতো পরিষ্কার। অগ্নিকুণ্ডের আগুন গিয়েচে নিবে। কুলিরা সব কুণ্ডলী পাকিয়ে আগুনের ওপরে শুয়ে আছে। কোনোদিকে কোনো শব্দ নেই।

হঠাৎ শংকরের দৃষ্টি পড়ল তার পাশে – এখানে তো তিরুমল আপ্পা বসে তার সঙ্গে গল্প করিছল। সে কোথায়? তাহলে হয়তো সে তাঁবুর মধ্যে ঘুমুতে গিয়ে থাকবে।

শংকরও নিজে উঠে শুতে যাবার উদ্যোগ করচে, এমন সময়ে অল্প দূরেই পশ্চিম কোণে মাঠের মধ্যে ভীষণ সিংহগর্জন শুনতে পাওয়া গেল। রাত্রির অস্পষ্ট জ্যোৎস্নালোক যেন কেঁপে উঠল সে রবে। কুলিরা ধড়মড় করে জেগে উঠল। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বন্দুক নিয়ে তাঁবুর বাইরে এলেন। শংকর জীবনে এই প্রথম শুনলে সিংহের গর্জন – সেই দিক-দিশাহীন তৃণভূমির মধ্যে শেষ রাত্রের জ্যোৎস্নায় সে গর্জন যে কী এক অনির্দেশ অনুভূতি তার মনে জাগালে! তা ভয় নয়, সে এক রহস্যময় ও জটিল মনোভাব। একজন বৃদ্ধ মাসাই কুলি ছিল তাঁবুতে। সে বললে, সিংহ লোক মেরেচে। লোক না মরলে এমন গজন করবে না।

তাঁবুর ভেতর থেকে তিরুমলের সঙ্গী এসে হঠাৎ জানালে তিরুমলের বিছানা শূন্য। সে তাঁবুর মধ্যে কোথাও নেই।

কথাটা শুনে সবাই চমকে উঠল৷ শংকর-নিজে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে দেখে এল সত্যিই সেখানে কেউ নেই। তখনি কুলিরা আলো জ্বেলে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সব তাঁবুগুলোতে খোঁজ করা হল, নাম ধরে চিৎকার করে ডাকাডাকি করলে সবাই মিলে – তিরুমলের কোনো সাড়া মিলল না।

তিরুমল যেখানটাতে শুয়েছিল, সেখানটাতে ভালো করে দেখা গেল তখন। একটা কোনো ভারী জিনিসকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ মাটির ওপর সুস্পষ্ট। ব্যাপারটা বুঝতে কারও দেরি হল না। বাওবার গাছের কাছে তিরুমলের জামার হাতার খানিকটা টুকরো পাওয়া গেল। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বন্দুক নিয়ে আগে আগে চললেন, শংকর তাঁর সঙ্গে চলল। কুলিরা তাঁদের অনুসরণ করতে লাগল।

সেই গভীর রাত্রে তাঁবু থেকে দুরে মাঠে চারিদিকে অনেক জায়গা খোঁজা হল, তিরুমলের দেহের কোনো সন্ধান মিলল না। এবার আবার সিংহগর্জন শোনা কিন্তু দুরে। যেন এই নির্জন প্রান্তরের অধিষ্ঠাত্রী কোনো রহস্যময়ী রাক্ষসীর গেল- বিকট চিৎকার।

মাসাই কুলিটা বললে – সিংহ দেহ নিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ওকে নিয়ে আমাদের ভুগতে হবে। আরও অনেকগুলো মানুষ ও ঘায়েল না করে ছাড়বে না। সবাই সাবধান। যে সিংহ একবার মানুষ খেতে শুরু করে, সে অত্যন্ত ধূর্ত হয়ে ওঠে।

রাত যখন প্রায় তিনটে, তখন সবাই ফিরল তাঁবুতে। বেশ ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় সারা মাঠ আলো হয়ে উঠেছে। আফ্রিকার এই অংশে পাখি বড়ো একটা দেখা যায়। না দিনমানে, কিন্তু এক ধরনের রাত্রিচর পাখির ডাক শুনতে পাওয়া যায় রাত্রে সে সুর অপার্থিব ধরনের মিষ্টি। এইমাত্র সেই পাখি কোন্ গাছের মাথায় বহুদূরে ডেকে উঠল। মনটা এক মুহূর্তে উদাস করে দেয়। শংকর ঘুমুতে গেল না। আর সবাই তাঁবুর মধ্যে শুতে গেল কারণ পরিশ্রম কারও কম হয়নি। তাঁবুর সামনে কাঠকুটো জ্বালিয়ে প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ড করা গেল। শংকর সাহস করে বাইরে বসতে অবিশ্যি পারলে না—-এরকম দুঃসাহসের কোনো অর্থ হয় না। তবে সে দিনের খড়ের ঘরে শুয়ে জানলা দিয়ে বিস্তৃত জ্যোৎস্নালোকিত অজানা প্রান্তরের দিকে চেয়ে রইল।

মনে কী এক অদ্ভুত ভাব। তিরুলের অদৃষ্টলিপি এই জন্যেই বোধ হয় তাকে আফ্রিকায় টেনে এনেছিল। তাকেই বা কী জন্যে এখানে এনেচে তার অদৃষ্ট, কে জানে তার খবর ?

আফ্রিকা অদ্ভুত সুন্দর দেখতে কিন্তু আফ্রিকা ভয়ংকর! দেখতে বাবলা বনে ভরতি বাংলাদেশের মাঠের মতো দেখালে কী হবে, আফ্রিকা অজানা মৃত্যুসংকুল ! যেখানে সেখানে অতর্কিত নিষ্ঠুর মৃত্যুর ফাঁদ পাতা… পর মুহূর্তে কী ঘটবে, এ মুহূর্তে তা কেউ বলতে পারে না।

আফ্রিকা প্রথম বলি গ্রহণ করেচে – তরুণ হিন্দু যুবক তিরুমলকে। সে বলি চায়।

তিরুমল তো গেল, সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পে পরদিন থেকে এমন অবস্থা হয়ে উঠল। যে আর সেখানে সিংহের উপদ্রবে থাকা যায় না। মানুষ খেকো সিংহ অতি ভয়ানক জানোয়ার। যেমন সে ধূর্ত তেমনি সাহসী। সন্ধ্যা তো দূরের কথা, দিনমানেই একা বেশিদূর যাওয়া যায় না। সন্ধ্যার আগে তাঁবুর মাঠে নানা জায়গায় বড়ো বড়ো আগুনের কুণ্ড করা হয়, কুলিরা আগুনের কাছ ঘেঁষে বসে গল্প করে, রান্না করে, সেখানে বসেই খাওয়া-দাওয়া করে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বন্দুক হাতে রাত্রে তিন-চার বার তাঁবুর চারিদিকে ঘুরে পাহারা দেন, ফাঁকা আওয়াজ করেন – এত সতর্কতার মধ্যেও একটা কুলিকে সিংহ নিয়ে পালাল তিরুমলকে মারবার ঠিক দুদিন পরে সন্ধ্যা রাত্রে। তার পরদিন একটা সোমালি কুলি দুপুরে তাঁবু থেকে তিনশো গজের মধ্যে পাথরের ঢিবিতে পাথর ভাঙতে গেল সন্ধ্যায় সে আর ফিরে এল না।

সেই রাত্রেই, রাত দশটার পরে, শংকর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের তাঁবু থেকে ফিরচে, লোকজন কেউ বড়ো একটা বাইরে নেই, সকাল সকাল যে যার ঘরে শুয়ে পড়েচে, কেবল এখানে ওখানে দু-একটা নির্বাপিত-প্রায় অগ্নিকুণ্ড। দূরে শেয়াল ডাকচে শেয়ালের ডাক শুনলেই শংকরের মনে হয় সে বাংলাদেশের পাড়াগাঁয়ে আছে। চোখ বুজে সে নিজের গ্রামটা ভারবার চেষ্টা করে, তাদের ঘরের কোণের সেই বিলিতি-আমড়া গাছটা ভাববার চেষ্টা করে – আজও সে একবার থমকে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি চোখ বুজলে।

কী চমৎকার লাগে! কোথায় সে? সেই তাদের গাঁয়ের বাড়িতে জানলার কাছে। তক্তপোশে শুয়ে? বিলিতি আমড়া গাছটার ডালপালা চোখ খুললেই চোখে পড়বে? ঠিক? দেখবে সে চোখ খুলে?

শংকর ধীরে ধীরে চোখ খুললে।

অন্ধকার প্রান্তর। দূরে সেই বড়ো বাওবাব গাছটা অস্পষ্ট অন্ধকারে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার মনে হল সামনের একটা ছাতার মতো গোল খড়ের নীচু চালের ওপর একটা কী যেন নড়চে। পরক্ষণেই সে ভয়ে ও বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেল।

প্রকাণ্ড একটা সিংহ খড়ের চাল থাবা দিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করবার চেষ্টা করচে ও মাঝে মাঝে নাকটা চালের গর্তের কাছে নিয়ে গিয়ে কীসের যেন ঘ্রাণ নিচ্চে!

তার কাছ থেকে চালাটার দূরত্ব বড়ো জোর বিশ হাত।

শংকর বুঝলে সে ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। সিংহ চালার খড় খুঁচিয়ে গর্ত করতে ব্যস্ত, সেখান দিয়ে ঢুকে সে মানুষ নেবে – শংকরকে সে এখনও দেখতে পায়নি। তাঁবুর বাইরে কোথাও লোক নেই, সিংহের ভয়ে বেশি রাত্রে কেউ বাইরে থাকে না। নিজে সে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, একগাছা লাঠি পর্যন্ত নেই হাতে।

শংকর নিঃশব্দে পিছু হঠতে লাগল ইঞ্জিনিয়ারের তাঁবুর দিকে, সিংহের দিকে চোখ রেখে। এক-মিনিট … দু-মিনিট… নিজের স্নায়ুমণ্ডলীর ওপর যে তার এত কর্তৃত্ব ছিল, তা এর আগে শংকর জানত না। একটা ভীতিসূচক শব্দ তার মুখ দিয়ে বেরুল না বা সে হঠাৎ পিছু ফিরে দৌড় দেবার চেষ্টাও করলে না।

ইঞ্জিনিয়ারের তাঁবুর পর্দা উঠিয়ে সে ঢুকে দেখলে সাহেব টেবিলে বসে তখনও কাজ করছে। সাহেব ওর রকম-সকম দেখে বিস্মিত হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই ও বললে – সাহেব, সিংহ!
সাহেব লাফিয়ে উঠল কই? কোথায়?

বন্দুকের র‍্যাকে একটা ৩৭৫ ম্যানলিকার রাইফেল ছিল। সাহেব সেটা নামিয়ে নিলে। শংকরকে আর একটা রাইফেল দিলে। দুজনে তাঁবুর পর্দা তুলে আস্তে আস্তে বাইরে এল। একটু দূরেই কুলি লাইনের সেই গোল চালা। কিন্তু চালার ওপর কোথায় সিংহ? শংকর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে এই মাত্র দেখে গেলাম স্যার। ওই চালার ওপর সিংহ থাবা দিয়ে খড় খোঁচাচ্ছে।

সাহেব বললে – পালিয়েচে। জাগাও সবাইকে।

একটু পরে তাঁবুতে মহা শোরগোল পড়ে গেল। লাঠি, সড়কি, গাঁতি, মুগুর নিয়ে কুলির দল হল্লা করে বেরিয়ে পড়ল খোঁজ খোঁজ চারদিকে, খড়ের চালে সত্যিই ফুটো দেখা গেল। সিংহের পায়ের দাগও পাওয়া গেল। কিন্তু সিংহ উধাও হয়েচে। আগুনের কুণ্ডে বেশি করে কাঠ ও শুকনো খড় ফেলে আগুন আবার জ্বালানো হল। সে রাত্রে অনেকেরই ভালো ঘুম হল না, কিন্তু তাঁবুতে শুয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল একটা মহা শোরগোলের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। মাসাই কুলিরা ‘সিম্বা সিম্বা’ বলে চিৎকার করচে। দু-বার বন্দুকের আওয়াজ হল। শংকর তাঁবুর বাইরে এসে ব্যাপার জিজ্ঞাসা করে জানলে সিংহ এসে আস্তাবলের একটা ভারবাহী অশ্বতরকে জখম করে গিয়েচে – এই মাত্র ! সবাই শেষ রাত্রে একটু ঝিমিয়ে পড়েচে আর সেই সময়ে এই কাণ্ড।

পরদিন সন্ধ্যার ঝোঁকে একটা ছোকরা কুলিকে তাঁবু থেকে একশো হাতের মধ্যে সিংহে নিয়ে গেল। দিন চারেক পরে আর একটা কুলিকে নিলে বাওবাব গাছটার তলা থেকে।

কুলিরা আর কেউ কাজ করতে চায় না। লম্বা লাইনে গাঁতিওয়ালা কুলিদের অনেক সময়ে খুব ছোটো দলে ভাগ করে কাজ করতে হয় – তারা তাঁবু ছেড়ে দিনের বেলাতেও বেশিদূর যেতে চায় না। তাঁবুর মধ্যে থাকাও রাত্রে নিরাপদ নয়। সকলেরই মনে ভয় – প্রত্যেকেই ভাবে এবার তার পালা। কাকে কখন নেবে কিছু স্থিরতা নেই। এই অবস্থায় কাজ হয় না। কেবল মাসাই কুলিরা অবিচলিত রইল তারা যমকেও ভয় করে না। তাঁবু থেকে দু-মাইল দূরে গাঁতির কাজ তারাই করে, সাহেব বন্দুক নিয়ে দিনের মধ্যে চার-পাঁচবার তাদের দেখাশোনা করে আসে।

কত নতুন ব্যবস্থা করা হল, কিছুতেই সিংহের উপদ্রব কমল না। কত চেষ্টা করেও সিংহ শিকার করা গেল না। অনেকে বললে সিংহ একটা নয়, অনেকগুলো —ক-টা মেরে ফেলে যাবে?

সাহেব বললে – মানুষ-খেকো সিংহ বেশি থাকে না। এ একটা সিংহেরই কাজ।

একদিন সাহেব শংকরকে ডেকে বললে বন্দুকটা নিয়ে গাঁতিদার কুলিদের একবার দেখে আসতে। শংকর বললে – সাহেব, তোমার ম্যানলিকারটা দাও।

সাহেব রাজি হল। শংকর বন্দুক নিয়ে একটা অশ্বতরে চড়ে রওনা হল – তাঁবু থেকে মাইল খানেক দূরে এক জায়গায় একটা ছোটো জলা। শংকর দূর থেকে জলাটা যখন দেখতে পেয়েচে, তখন বেলা প্রায় তিনটে। কেউ কোনো দিকে নেই, রোদের ঝাঁজ মাঠের মধ্যে তাপ-তরঙ্গের সৃষ্টি করেচে।

হঠাৎ অশ্বতর থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আর কিছুতেই সেটা এগিয়ে যেতে চায় না। শংকরের মনে হল জায়গাটার দিকে যেতে অশ্বতরটা ভয় পাচ্ছে। একটু পরে পাশের ঝোপে কী যেন একটা নড়ল। কিন্তু সেদিকে চেয়ে সে কিছু দেখতে পেল না। সে অশ্বতর থেকে নামল। তবুও অশ্বতর নড়তে চায় না।

হঠাৎ শংকরের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঝোপের মধ্যে সিংহ তার জন্যে ওঁত পেতে বসে নেই তো? অনেক সময়ে এরকম হয় সে জানে, সিংহ পথের পাশে ঝোপঝাপের মধ্যে লুকিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নিঃশব্দে তার শিকারের অনুসরণ করে। নির্জন স্থানে সুবিধা বুঝে তার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ে। যদি তাই হয়? শংকর অশ্বতর নিয়ে আর এগিয়ে যাওয়া উচিত বিবেচনা করলে না। ভাবলে তাঁবুতে ফিরেই যাই। সবে সে তাঁবুর দিকে অশ্বতরের মুখটা ফিরিয়েছে, এমন সময় আবার ঝোপের মধ্যে কী একটা নড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক সিংহগর্জন এবং একটা ধূসর বর্ণের বিরাট দেহ সশব্দে অশ্বতরের ওপর এসে পড়ল। শংকর তখন হাত চারেক এগিয়ে আছে। সে তখনি ফিরে দাঁড়িয়ে বন্দুক উঁচিয়ে উপরি উপরি দু-বার গুলি করলে। গুলি লেগেচে কি না বোঝা গেল না, কিন্তু তখন অশ্বতর মাটিতে লুটিয়ে পড়েচে – ধূসর বর্ণের জানোয়ারটা পলাতক। শংকর পরীক্ষা করে দেখলে অশ্বতরের কাঁধের কাছে অনেকটা মাংস ছিন্নভিন্ন, রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় সেটা ছটফট করচে। শংকর এক গুলিতে তার যন্ত্রণার অবসান করলে। তারপর সে তাঁবুতে ফিরে এল।

সাহেব বললে, সিংহ নিশ্চয়ই জখম হয়েচে। বন্দুকের গুলি যদি গায়ে লাগে তবে দস্তুরমতো জখম তাকে হতেই হবে। কিন্তু গুলি লেগেছিল তো? শংকর বললে গুলি লাগালাগির কথা সে বলতে পারে না। বন্দুক ছুঁড়েছিল, এই মাত্র কথা। লোকজন নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে দু-তিন দিনেও কোনো আহত বা মৃত সিংহের
সন্ধান কোথাও পাওয়া গেল না!

জুন মাসের প্রথম থেকে বর্ষা নামল। কতটা সিংহের উপদ্রবের জন্যে, কতকটা বা জলাভূমির সান্নিধ্যের জন্যে অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় তাঁবু ওখান থেকে উঠে গেল।

শংকরকে আর কনস্ট্রাকশন তাঁবুতে থাকতে হল না। কিসুমু থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে একটা ছোটো স্টেশনে সে স্টেশন মাস্টারের কাজ পেয়ে জিনিসপত্র নিয়ে সেখানেই চলে গেল।

আরও পড়ুন –
অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরী পাটনি (কবিতা)- ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর
পরিচয় (কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাট (কবিতা) – যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
এখানে আকাশ নীল (কবিতা) – জীবনানন্দ দাশ
সামান্যই প্রার্থনা (কবিতা) – বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী
দস্যু -কবলে (গল্প) – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
নতুনদা (গল্প) – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সিংহের দেশ (গল্প) – বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়
দেবতামুড়া ও ডম্বুর (গল্প) – সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা
সুভা (ছোটোগল্প) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বেড়া (ছোটোগল্প) – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

Spread the love

You cannot copy content of this page